এটি ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে মিত্রবাহিনী যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হতো, তবে মানবজাতির জন্য ফলাফল বিপর্যয়কর হতো। জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি শাসন ছিল বিস্তৃত ও নির্মম, যা পুরো ইউরোপজুড়ে আক্রমণ চালিয়েছিল এবং হলোকাস্টের মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত করেছিল। হলোকাস্টের মাধ্যমে ৬০ লাখ ইহুদি এবং আরও লাখ লাখ “অপ্রয়োজনীয়” বলে বিবেচিত মানুষকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞ ও বিস্তারবাদ ছিল এক বিকৃত মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা, যা হিটলার তার বই Mein Kampf-এ তুলে ধরেছিলেন। তিনি সেখানে বর্ণনা করেছিলেন কীভাবে একটি জাতিগতভাবে বিশুদ্ধ ও সাংস্কৃতিকভাবে একরূপ জার্মানি গঠন করতে হবে এবং “Lebensraum” বা “জীবনযাপনের জন্য স্থান” তৈরি করতে হবে, যেখানে কেবলমাত্র বিশুদ্ধ জার্মান জনগণ বসবাস করতে পারবে।
যদি হিটলার জয়ী হতো
অনেক ঐতিহাসিক ও লেখক কল্পনা করেছেন, হিটলার যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হতো তবে বিশ্ব কেমন হতো। লেখক ফিলিপ কে. ডিক তার উপন্যাস The Man in the High Castle-এ এমনই একটি কাল্পনিক ভবিষ্যতের চিত্র এঁকেছেন, যেখানে নাৎসি জার্মানি ও জাপান একত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও দখল করে ফেলে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাৎসি শাসনকে কল্পনা করা কঠিন, তবুও বাস্তবিক অর্থে রাশিয়ার জন্য হিটলারের পরিকল্পনা ছিল আরও স্পষ্ট ও ভয়াবহ।
অপারেশন বারবারোসা এবং পূর্বাঞ্চল দখলের প্রচেষ্টা
হিটলার যখন তার আক্রমণাত্মক যুদ্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেন, তখন তিনি প্রথমে পশ্চিম ইউরোপে সফলতা অর্জন করেন। কিন্তু ১৯৪১ সালে, তিনি আকস্মিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেন এবং Operation Barbarossa চালু করেন। এটি ছিল পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অভিযান। হিটলার বিশ্বাস করতেন, রাশিয়া জয় করতে পারলে তিনি সমগ্র ইউরোপের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন।

কিন্তু রাশিয়ার বিপুল সম্পদ এবং বিশাল ভূখণ্ড শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং বার্লিনের পতনের পথ তৈরি করে। যদিও শুরুতে নাৎসি বাহিনী বেশ কিছু অঞ্চল দখল করেছিল, কিন্তু সোভিয়েত সেনাদের প্রতিরোধ এবং নির্মম শীতকাল জার্মান বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত করে। তবে যদি তারা সফল হতো, তাহলে হিটলার রাশিয়ার উপর নির্মম ও ভয়ংকর এক শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দিত।
রাশিয়ার জাতিগত নিধন
নাৎসি মতাদর্শে “Lebensraum” বা “জীবনযাপনের জন্য স্থান” ছিল এক প্রধান নীতি। হিটলারের পরিকল্পনা ছিল পূর্ব ইউরোপ দখল করা এবং সেখানে জার্মান জনগণের জন্য নতুন বসতি স্থাপন করা। তিনি মনে করতেন, জার্মান জাতির বৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য বিশাল জমির প্রয়োজন, যা তিনি রাশিয়া থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন। যদি রাশিয়া পরাজিত হতো, তবে সম্ভাব্যভাবে সেখানে এক ভয়াবহ জাতিগত নিধন পরিচালিত হতো।
হিটলার পরিকল্পনা করেছিলেন, রাশিয়া থেকে “অনাকাঙ্ক্ষিত” জনগোষ্ঠীকে হত্যা করা বা সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করা হবে এবং সেই অঞ্চলকে “জার্মানিফাই” করা হবে। বিশেষত, রাশিয়ান কমিউনিস্ট নেতা এবং বুদ্ধিজীবীদের নির্মূল করা হতো। এই পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা।
মস্কো ও লেনিনগ্রাদ ধ্বংসের পরিকল্পনা
রাশিয়ার জনগণের ওপর নাৎসি বাহিনীর নির্মম পরিকল্পনার প্রমাণ পাওয়া যায় যুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন কৌশলগত নথিপত্র থেকে। ১৯৪১ সালের ৮ জুলাই, নাৎসি জার্মানির জেনারেল ফ্রান্জ হাল্ডার তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন যে হিটলার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন মস্কো ও লেনিনগ্রাদ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলার ব্যাপারে।
হিটলারের নির্দেশ ছিল এই শহরগুলিকে এমনভাবে ধ্বংস করা হবে যেন সেখানকার জনগণ শীতে অনাহারে মারা যায়। এই শহরগুলোতে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে নাৎসি বাহিনী সেগুলিকে মানববসতিহীন করে ফেলতে চেয়েছিল। সোভিয়েত শহরগুলোর সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্নকরণের জন্য লুফটওয়াফে (জার্মান বিমানবাহিনী) ব্যবহার করা হতো।
১৯৪২-৪৩ সালের স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধ ছিল ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ, যেখানে জার্মান বাহিনী পুরো শহরটি পুড়িয়ে দেয়। যদি মস্কো বা লেনিনগ্রাদও দখল হতো, তাহলে নাৎসিরা সেখানেও একই ধরনের গণহত্যা চালাতো।

হিটলারের পরাজয় এবং ইতিহাসের মোড় ঘোরা
যদিও শুরুতে জার্মান বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু শীতকালে তাদের অবস্থা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র ও রসদের অভাবে জার্মান সৈন্যরা দুর্বল হয়ে পড়ে, যার ফলে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত বাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করে।
এই যুদ্ধকে ইতিহাসবিদরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘোরানো ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করেন। যদি হিটলার রাশিয়ায় সফল হতো, তাহলে ইউরোপের ভাগ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারত। কিন্তু সোভিয়েত প্রতিরোধ এবং জার্মান বাহিনীর দুর্বল পরিকল্পনার কারণে হিটলারের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি, বরং তার সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয়।