কী আছে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে?

প্রকাশের তারিখ:

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটিতে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দপ্তর। এটি একটি কমপ্লেক্স। ১৯৫২ সালে নির্মাণের পর থেকে এটি জাতিসংঘের দাপ্তরিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ঐ বছরের ৯ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় দপ্তরটি।

অবস্থান

নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যানহাটন বরোর টার্টল বে এলাকায় এটি অবস্থিত। এই কমপ্লেক্সের সামনে ইস্ট রিভার অবস্থিত। এর পশ্চিমে ফার্স্ট এভিনিউ, দক্ষিণে ইস্ট ফোর্টি সেকেন্ড স্ট্রিট, ইস্ট ফোর্টি এইটথ স্ট্রিট উত্তরে এবং পূর্বে ইস্ট রিভার অবস্থিত। টার্টল বে নামটি অনেক সময় জাতিসংঘের সদর দপ্তর বা পুরো জাতিসংঘকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

শাখা

জাতিসংঘের তিনটি অতিরিক্ত, সহায়ক ও আঞ্চলিক সদর দপ্তর রয়েছে। এগুলো জেনেভা, ভিয়েনা ও নাইরোবিতে অবস্থিত। এই দপ্তরগুলো জাতিসংঘকে তার নির্দেশনা প্রতিনিধিত্বকরণে, কূটনৈতিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে ও কিছু অতিরাষ্ট্রিক সুবিধা লাভে সাহায্য করে। তবে নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তর কেবল জাতিসংঘের প্রধান ছয়টি অঙ্গসংগঠন পরিচালনা করে। এছাড়া জাতিসংঘের ১৫টি বিশেষায়িত সংস্থার দপ্তরগুলো নিউ ইয়র্কের বাইরে অন্যান্য দেশে অবস্থিত।

নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত হলেও জাতিসংঘ সদর দপ্তর কর্তৃক অধিকৃত জায়গাটি জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক অধিকারের আওতাভুক্ত। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি চুক্তির মাধ্যমে জাতিসংঘ কৌশলগতভাবে এই জায়গাটিকে অনেকটা অতিরাষ্ট্রিকভাবে ব্যবহার করে। তবে পুলিশ প্রশাসন, দমকল ব্যবস্থা ইত্যাদি ব্যবহারের জন্য জাতিসংঘ অধিকাংশ স্থানীয়, প্রাদেশিক ও রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চলে।

আয়তন

এই ভবনের মূল অংশ ১৯৪৮-১৯৫২ সালে নির্মিত হয়। এটি ১৭ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এই জায়গাটি তৎকালীন নিউ ইয়র্কের এক শীর্ষস্থানীয় আবাসন কোম্পানির কাছ থেকে কেনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি নেলসন রকফেলার এই জমি কেনার ব্যবস্থা করেন। এই জমি কেনার জন্য প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন ডলার তার পিতা জন রকফেলার দান করেন। রকফেলার পরিবারের ব্যক্তিগত স্থাপত্য উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট স্থপতি ওয়ালেস হ্যারিসনকে জাতিসংঘ সদর রপ্তর পরিকল্পনায় পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি এবং তার প্রতিষ্ঠান হ্যারিসন অ্যান্ড অ্যাব্রামোভিটজ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তত্ত্বাবধায়ন করে।

পরিকল্পনা ও নির্মাণ

সদর দপ্তর নির্মাণের জন্য জাতিসংঘ বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় স্থপতিদের সমন্বয়ে একটি বহুজাতিক কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। মার্কিন স্থপতি ওয়ালেস হ্যারিসনকে এই পরিকল্পনার জন্য পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীদের নিয়ে একটি পরিকল্পনা উপদেষ্টাদের একটি বোর্ড গঠন করা হয়। এই বোর্ডে সোভিয়েত ইউনিয়নের এন. ডি. ব্যাসোভ, বেলজিয়ামের গ্যাস্টন ব্রুনফট, কানাডার আর্নেস্ট কর্মিয়ার, ফ্রান্সের লে কর্বুজিয়ের, চীনের লিয়াং-সিউ চেং, সুইডেনের সভেন মার্কিলাস, ব্রাজিলের অস্কার নিয়েমার, যুক্তরাজ্যের হওয়ার্ড রবার্টসন, অস্ট্রেলিয়ার জি. এ. সলিউক্স এবং উরুগুয়ের জুলিও ভিলামাও ছিলেন।

Headquarters of the United Nations 1
ছবি : সংগৃহীত

জাতিসংঘ প্রথমে চিন্তা করেছিলো সদর দপ্তরের জন্য একটি স্বাধীন-স্বয়ংসম্পূর্ণ শহর নির্মিত হবে। কিন্তু নানাবিধ বাধা-বিপত্তির কারণে এই উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পরিকল্পনা বোর্ড কমপক্ষে ৪৫টি নকশা প্রস্তুত করে। অনেক পর্যলোচনার পরে হ্যারিসন, অস্কার নিয়েমারের ৩২ নং প্রকল্প ও লে কর্বুজিয়েরের ২৩ নং প্রকল্পের ভিত্তিতে চূড়ান্ত নকশা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। এই চূড়ান্ত নকশাকে পরবর্তিতে আরো কিছু পরিবর্তন ও সংশোধন করা হয় এবং এর ভিত্তিতে ভবনটি নির্মিত হয়।

মহাসচিবের কার্যালয়টি ভবনের ৩৮তম তলায় অবস্থিত। ১৯৪৮ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হলেও ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর ১৯৪৯ সালের ২৪ অক্টোবর স্থাপিত হয়। এর কাজ শেষ হয় ১৯৫২ সালে। এই নির্মাণকাজের জন্য প্রয়োজনীয় ৬৫ মিলিয়ন ডলার অর্থ সুদমুক্ত ঋণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রদান করে।

আন্তর্জাতিক বৈশিষ্ট্য

জাতিসংঘ সদর দপ্তরের একটি বৈশ্বিক মর্যাদা রয়েছে। একারণে মাঝেমধ্যে জাতিসংঘের নিয়ম-নীতি নিউ ইয়র্ক শহরের আইনকে উপেক্ষা করে, কিন্তু অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে এসব নীতি প্রযোজ্য হয় না। জাতিসংঘ সদর দপ্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। জাতিসংঘের কিছু সদস্যের কূটনৈতিক অব্যাহতি সুবিধা রয়েছে। জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ব্যবসা ও মুদ্রা আদান-প্রদানে মার্কিন ডলার ব্যবহৃত হয়। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দৈনিক তথ্যের আদান-প্রদানে ও সদর দপ্তরের সকল চিহ্ন ইংরেজি ও ফরাসি ভাষাতে লিখিত। ফরাসি ও স্প্যানিশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের দাপ্তরিক ভাষা। আরবি, চীনা, ইংরেজি, ফরাসি, রাশিয়ান ও স্প্যানিশ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের দাপ্তরিক ভাষা।

এই ভবনের ঠিকানা হল জাতিসংঘ সদর দপ্তর, নিউ ইয়র্ক, এনওয়াই ১০০১৭, যুক্তরাষ্ট্র। নিরাপত্তার কারণে এই ঠিকানায় প্রেরিত সব চিঠি জীবাণুমুক্ত করা হয়। জাতিসংঘ ডাক প্রশাসন জাতিসংঘের জন্যে স্ট্যাম্প প্রণয়ন করে যা এই ভবন থেকে প্রেরিত সব চিঠিতে যুক্ত করা হয়। সাংবাদিকরা যখন এই ভবন থেকে রিপোর্টিং করে তখন তারা তাদের অবস্থান হিসেবে ‘নিউ ইয়র্ক’-এর পরিবর্তে “জাতিসংঘ” ব্যবহার করে।

ভবনের কাঠামো

জাতিসংঘ সদর দপ্তর কমপ্লেক্সে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভবন রয়েছে। এর মধ্যে জাতিসংঘ সচিবালয় ভবনটি এই সদর দপ্তরের চিত্রায়নে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়। এছাড়া সাধারণ পরিষদ ভবন, কনফারেন্স ও ভিজিটরস সেন্টারও গুরুত্বপূর্ণ ভবন হিসেবে কমপ্লেক্সে দৃশ্যমান। সদর দপ্তরের সীমানার ঠিক অভ্যন্তরে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের পতাকার সারি অবস্থিত। এখানে জাতিসংঘের পতাকাও অবস্থিত। পতাকাগুলো ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে স্থাপিত।

সাধারণ অধিবেশন ভবনে অধিবেশন হল অবস্থিত। এর ধারণক্ষমতা ১৮০০। ১৬৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১১৫ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট এই হলটি কমপ্লেক্সের সর্বাধিক বড় ঘর। এই হলে ফরাসি ফের্নাড লিগার নির্মিত দুইটি প্রাচীরচিত্র রয়েছে। হলের সামনের ভাগে বক্তৃতা মঞ্চ অবস্থিত। সাধারণ অধিবেশনের প্রেসিডেন্ট, মহাসচিবের জন্য বক্তৃতা মঞ্চে সবুজ মার্বেলের তৈরি ডেস্ক রয়েছে। এর পেছনে রয়েছে সোনালী পটভূমিতে অঙ্কিত জাতিসংঘের প্রতীক।

উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন

শেয়ার করুন:

সাবস্ক্রাইব

জনপ্রিয়

এ সম্পর্কিত আরও কিছু পোস্ট
Related

বিমানবন্দর নেই বিশ্বের যে পাঁচ দেশের

একটি স্বাধীন দেশের বিমানবন্দর নেই এমনটা শুনতেও কেমন যেন...

ভুলে আবিষ্কার হয়েছিল এক্স-রে!

ঊনবিংশ শতাব্দীর এক পদার্থবিদ, যিনি পরীক্ষাগারে সামান্য ভুল থেকে...

বৈচিত্র্যময় কিছু জনগোষ্ঠীর কথা : চাচাপোয়া

আদিবাসী, গোত্র বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলতে এমন এক ধরণের...

আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস

প্রতিবছর ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সকল সদস্যভূক্ত দেশে পালিত হয় আন্তর্জাতিক...