শিশুর যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে অভিভাবকের করণীয়

বর্তমানে খবর কাগজে বা অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে চোখ বুলালে আমরা ধর্ষণ কিংবা যৌন নিপীড়নের খবর দেখতে পাই। বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকারদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৮৬ জনের বয়স বিশে নিচে। দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা দ্বিগুন হয়েছে। বাড়ছে ধর্ষণজনিত হত্যা। সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী মেয়েরা। এর মাধ্যমে বোঝা যায় বাংলাদেশে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের হার কতোটা বেশি।

মূলত পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বা প্রতিবেশীরাই শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন করে থাকে বেশি। এছাড়া রাস্তাঘাটে, পাবলিক পরিবহনে অপরিচিত মানুষ, স্কুল শিক্ষক কিংবা গৃহশিক্ষক, বাসায় কাজ করলে মালিক বা কর্মচারীদের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের কথা শোনা যায়। তাই বর্তমানে দেশে শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিটি অভিভাবকই চিন্তাতে পড়ে গেছেন।

অনেকেই আবার মনে করেন, আমার শিশু নিরাপদ আছে। তাদের সাথে এমন কিছু হবে না। তবে এমনটি ভাবা আদৌ ঠিক নয়। আপনার নির্লিপ্ততা হয়তোবা আপনার শিশুর ক্ষেত্রেও বিপদ বয়ে আনতে পারে। একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে শিশুর যৌন সুরক্ষার বিষয়ে আপনাকে সর্বদা নজর রাখতে হবে। যৌন নির্যাতনের শিকার হলে শিশু হয়তোবা লজ্জা কিংবা ভয়ে কাউকে কিছু জানাবে না। তবে সে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বে। মানসিক ট্রমা আজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াবে সে। তাই এখনই সময়, আপনার সচেতন হওয়ার, অন্যকে সচেতন করার এবং শিশুর যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার।

শিশুর যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে করণীয় কিছু বিষয় মেনে চলতে পারেন। এগুলো শতভাগ আপনার শিশুর নিশ্চয়তা হয়তোবা দিতে পারবে না। তবে এগুলো মেনে চললে শিশুর যৌন নির্যাতনের হার কিছুটা কমবে বলে মনে করি।

প্রথমত, আমাদের শিশুরা বুঝতে বা বলতে শিখলেই তাদের শরীরের হাত, পা, নাক, চোখ ইত্যাদি চেনা শেখাই। ঠিক তেমনিভাবে শৈশব থেকেই তাদের শরীরের গোপন অঙ্গগুলোও চিনিয়ে দিন। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি এগুলো যে অন্যদের থেকে লুকিয়ে রাখতে বা রক্ষা করতে হয় সেটি ভালোভাবে বুঝিয়ে দিন। কেউ স্পর্শতো দূরের কথা এগুলো স্পর্ষ করার কথাও যাতে না বলতে পারে সে বিষয়ে তাদের সচেতন করতে হবে। এমনকি ডাক্তারের কাছে গেলেও বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়া এসব অঙ্গ দেখানো যাবে না। একবার বললে হয়তোবা সেটি তাদের সেভাবে গ্রহণ করতে পারবে না। তাই একাধিকবার সেটি বুঝিয়ে দিতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, সাধারণত চার থেকে নয় বছর বয়সে শিশুর বর্ধনশীল শরীরের প্রতি কৌতুহল জন্মায়। তাই এসময়ে তাদের শরীরকে ‘রেসপেক্ট’ করতে শিক্ষা দিন এবং বলুন ‘তোমার নিজস্ব শরীর শুধুমাত্র তুমিই স্পর্শ করতে পারবে’। অন্য শিশুদেরকেও তারা যাতে সেটি মেনে চলার জন্য বলে সে বিষয়ে অভ্যস্ত করে তুলুন।

তৃতীয়ত, শিশুকে বলুন যে তার শরীর নিয়ে কোনো গোপনীয়তা চলবে না। সে যাতে অনায়াসে আপনার সাথে এ সম্পর্কিত কথা শেয়ার করতে পারে সে বিষয়ে তাদের অভয় দিন। কেউ যদি তার শরীরের গোপনীয় অঙ্গগুলো দেখে ফেলে কিংবা স্পর্শ করে তাহলে যাতে দ্রুততম সময়ে আপনার সাথে শেয়ার করে সেটি জানাবে।

চতুর্থত, সন্তানের কথা গুরুত্বসহকারে নিতে হবে। বাচ্চারা যদি এই বিষয়ে কোনো কথা বলে তাহলে সেটি বিশ্বাস করতে হবে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও তাদের বলতে যাবেন না যে তুমি এটি বানিয়ে বলছো বা এটি বিশ্বাস করি না। মনে রাখবেন আপনি যদি তাদের কথা বিশ্বাস না করেন তাহলে আপনার প্রতি সন্তানের আস্থার জায়গাটি নষ্ট হবে। সে পরবর্তীতে এ বিষয়ে আর কিছু বলতে উৎসাহী হবে না। এছাড়া আপনার নির্লিপ্ততা কিংবা অবিশ্বাস যৌন নির্যাতনকারীর ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ তৈরি হবে।

পঞ্চমত, সামাজিক সম্পর্কের কথা সবসময়ই ভাববেন না। আপনার শিশুকে কার কোলো বা কার কাছে দিচ্ছেন সেটি সম্পর্কে গুরুত্ব দেয়া উচিত। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশি এমনকি পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমেই যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয়ে চুপ থাকবেন না।

ছষ্ঠত, শিশুদের আচরণে পরিবর্তন আসছে কিনা খেয়াল করুন। শিশুরা যদি কাউকে দেখে ভয় পায়, তার কোলে বা তার কাছে যেতে ভয় পায় তাহলে জোর করবেন না। বুঝবেন কোনো সমস্যা আছে। বাচ্চা যদি ভয় পেয়ে চমকে উঠে বা দু:স্বপ্ন দেখে তাহলেও সেটির কারণ বোঝার চেষ্টা করবেন। যে যদি চুপচাপ থাকে, সবাইকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে তাহলে বিষয়টি নিয়ে তার সাথে খোলামেলা আলোচনা করে জানতে চান কী ঘটেছে।

সপ্তমত, বাচ্চাকে না বলাতে শেখান। তারা যাতে তাদের শরীরের রক্ষা এবং অন্যের হস্তক্ষেপ নিজেরাই প্রতিহত করতে পারে তেমন শিক্ষা দিন। কেউ জড়িয়ে ধরলে কিংবা কিস করতে গেলে যাতে মানা করতে পারে এমনভাবে গড়ে তুলুন। ঐরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে সে যাতে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে পারে এবং আপনাদেরকে অবগত করে সেটি বোঝান।

অষ্টমত, অপরিচিত কেউ যাতে বাচ্চার ছবি না তোলে সেটি খেয়াল রাখুন। অনেক সময় বাচ্চার ছবি দেখে বিকৃতমনস্ক ব্যক্তিদের মনে খারাপ কাজের তাড়না তৈরি হয়। অনলাইনে বাচ্চাদের ছবি দেয়ার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকুন। কোথায় কার মনে কী আছে সেটি বোঝা দায়।

নবমত, মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন হন। শিশুদের সামনে কী টেলিভিশন শো বা মুভি দেখছেন বা তারা কী ধরণের শো ও মুভি দেখছে সেটি খেয়াল রাখুন। শিশুরা ডিজিটাল ডিভাইসে কী করে, কোন কোন সাইট বা কনটেন্ট দেখে, সেগুলো আদৌ তাদের উপযোগি কিনা সেটি তদারকি করুন। তাদের জন্য কী উপযোগি, কোনটা উপযোগি নয় সেটি সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিন।

দশমত, শিশুদের বয়স অনুযায়ী তাদের সেক্স এডুকেশন কতোটা হওয়া যথাযথ সেটি বুঝিয়ে বলতে হবে। তাদের অনেক অনেক প্রশ্নের বিপরীতে আপনার ছোট ছোট বা কম উত্তর হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই সতর্কতার সাথে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করবেন।

পরিশেষে শিশুদের মনে সাহস জোগান এবং তাদের মন থেকে ভয় দূর করুন। তারা যাতে কারো দ্বারা আক্রান্ত হলে ভাষায় না বললেও আপনাদেরকে সাংকেতিক ভাষায় বোঝাতে পারে সেটি শিখিয়ে দিন। মোট কথা তারা যেনো সব কথা আপনার সাথে নির্ভয়ে প্রকাশ করতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন